Saturday, November 03, 2007

ভারতচরিতমানস : সুবর্ণরেখা -- সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

Please click here to install Avro for Bangla fonts

ঊৎস-- অন্যান্য ও ঋত্বিকতন্ত্র : সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (প্রকাশনাঃ চলচ্ছবি, কলকাতা, ২১ মে, ২০০৫)

'সুবর্ণরেখা' ছবিটির দিকে তাকালে একথা বুঝতে আজ আর সংকটের সম্মুখীন হতে হয় না; আজ স্পষ্টই বোঝা যায় ঋত্বিক ঘটকের পক্ষে এই ছবি ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব চুক্তিপত্র | সুবর্ণরেখা দেখার পর আমার কেবলই মনে পড়ে রেমব্রান্টের 'রাতের পাহারা' (১৭৪২) | ওই ছবির তিমিরঘন প্রত্যাশা, মুখাবয়বের সচকিত অভিব্যক্তি ছাড়িয়ে যা আরো বড়ো প্রশ্ন নির্মাণ করে তা পটে একটি বালিকার উপস্থিতি | পটস্থ এই বালিকা তবে কে? সে যে ইতিহাস এ কথা বোঝার জন্য পৃথিবীকে বেশ কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হয়েছে । ঋত্বিক 'সুবর্ণরেখা'য় অনুরূপ পরীক্ষাই সম্পন্ন করেন । বেশ্যালয়ে যে কন্ঠস্বর দেববাণীর মতো ভেসে আসে সেই 'হে রাম' এক অলৌকিক, একসট্রাডায়জেটিক কথন, প্রায় ডেলফিক ওর‌্যাকলপ্রতিম যা সময়ের স্বাক্ষর । বস্তুত, ঋত্বিক ঘটক 'সুবর্ণরেখা'য় আর একবার ভারত আবিষ্কারের ঝুঁকি নিয়েছেন । স্টেশনে অভিরাম যখন মরণোন্মুখ বাগদী বঊটির মুখে মা'র পরিচয়প্ত্র খুঁজে পায় তখন আমরা বুঝতে পারি অন্যদিক থেকে, অপরদিক থেকে ঋত্বিক প্রণয়ন করছেন অন্ত্যজের রামায়ণ ।



একে আধুনিক দলিত রাজনীতির সংযোজনী বলা যাবে না; বরং চূড়ান্ত বিস্ময়ে উপলব্ধি করি যে ঋত্বিক জাতীয় মহাকাব্যটিকে আর্যাবর্তের সীমা পার করিয়ে দিতে চাইছেন । ইতিহাসের উৎসবিন্দু তাঁর জানা নেই, কিন্তু অপসৃয়মান পদচিহ্ন অনুসরণ করে সময়ের জরায়ূতে প্রবেশের গাঢ় আকাঙ্খা আছে । 'একমাত্র সত্যজিৎ রায়'- নামের ছোটো আলোচনায় ঋত্বিক সত্যজিতের প্রতি আমর্ম শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেও 'পথের পাঁচালী' ও 'অপুর সংসারে'র অন্তিম পর্যায় সম্পর্কে নিজের অসন্তোষ গোপন রাখেন নি । তিনি লেখেন - 'আর সেই মারাত্মক শেষ পঙক্তিটি -- "অপু নিশ্চিন্তিপুর ছাড়িয়া যায় নাই । সে আবার ফিরিয়া আসিয়াছে ।" বইয়ের প্রাণবস্তু বোধহয় এখানেই ছিল ।' বস্তুত, এই মন্তব্য ঋত্বিকমানসে ইতিহাসের গঠন সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোরেখা । তিনি পারেন না সত্যজিতের মতো নিবিড় আস্তিক্যে দীক্ষিত হয়ে ইতিহাসের সরলরৈখিক অগ্রসরণকে মেনে নিতে, সে অর্থে আমি একটু সাহস করেই বলব তিনি হয়তো 'প্রগতি'-বিষয়ক ধারণাতেও সময় বিশেষে আস্থা রাখেন না বরং আমাদের চেতনাকে আমূল প্রশ্নবিদ্ধ করেন । 'মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্ত্য সীমা' - 'সুবর্ণরেখা'র সেই মহেন্দ্রক্ষণ তাঁকে আশাশীল করে নি কারখানার ভেতরে; বরং ফুকো প্রমুখ ইউরোপীয় মহাজনদের কাছে হাত না পেতেই তিনি গ্যাগারিনের রূপকে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে ছুড়ে ফেলেছেন চুল্লীর প্রহরে । আমি বলব ঋত্বিক এত দ্ব্যর্থহীনভাবে আমাদের জ্ঞানের সঞ্চার পথটিকে আর কোনো ছবিতে বিদ্রূপ ও পরীক্ষা করেন নি । তাঁর সব ছবিতেই শিকড়ে ফিরে যাবার টান আছে, কিন্তু মহাপ্রস্থানের পরে স্বর্গারোহণ পর্বে মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি চেতনার এত তীব্র জ্যা-বদ্ধ টান আর কোথাও নেই ।

'সুবর্ণরেখা' প্রসঙ্গে বারে বারে মনে হয় কী চক্ষুহীনই আমরা ছিলাম । ঋত্বিক বাস্তুহারা কলোনীর নিতান্ত স্থানিক ও কালিক বিপর্যয়কে গান্ধী-প্রয়াণের ঐতিহাসিক নক্ষত্র পতনের সংঘাতে জুড়ে দিয়ে আসলে অবতরণ করতে চান এক পুরাণকথার পৃথিবীতে যেখানে বৃদ্ধটি টাইরিয়াসের মতো সংস্কৃত বিলাপোক্তি উচ্চারণ করে যায় । 'সুবর্ণরেখা' সমস্ত আখ্যান জুড়েই সময়ের দুটি স্তরকে কাছে ডেকেছে । আমাদের চোখে দেখা কিশোরীটি কখন যে মীরাবাঈতে রূপান্তরিত হয়েছে, এক বৃদ্ধের সান্তনাবাক্য কিভাবে দূরাগত আকাশবাণীর মতো গম্ভীর হয়ে গেছে,কীভাবে সহস্র নরকমন্থনের পর আমাদের গীতা, ঊপনিষদ-ব্যবহৃত মিথ্যার মতো অলীক সান্তনা তা যাঁরা 'ওয়েস্টল্যান্ড' পড়েন বা 'লা দলচে ভিতা' দেখেন তাঁরা আগেও অনুমান করতে পেরেছিলেন । কিন্তু আরো গভীরভাবে যা মনে হয় তা হল এই চলচ্চিত্রের মতন একটা আধুনিক যন্ত্রনির্ভর শাস্ত্র ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে এই প্রথম ঋত্বিক দীপ্ত ব্রাহ্মণের মতো প্রত্যাঘাত হানলেন । অধীত জ্ঞান এবং দৃষ্ট অভিজ্ঞতা দিয়েই 'সুবর্ণরেখা' চলচ্চিত্রে তিনি আমাদের ইউরোপীয় আধুনিকতা বিষয়ক-ধারণাকে 'প্রাদেশিকতা' মুক্ত করেছেন । বলা চলে 'সুবর্ণরেখা'উত্তর ঔপনিবেশিকতার আবহে আমাদের ইতিহাসের নবনির্মাণ । গার্সিয়া মার্কেজ স্বদেশে ছড়িয়ে থাকা সময়ের টুকরোগুলো কী বিচিত্র বিন্যাসেই না সাজিয়ে এঁকে রাখতে চেয়েছেন স্বদেশের মানচিত্র, ভূগোলের প্রতিলিপি, আত্মার বিবরণী ! পথনির্দেশিকা তার নেই, তাকে মায়া বাস্তবের আশ্রয় নিতে হয়েছে । উপরন্তু উপনিবেশবাদ লাতিন আমেরিকাতে শরীরের সংস্থানও প্রায়ই হরণ করেছে । ঋত্বিকের অতিচেতনা হয়তো মতাদর্শে ভিন্ন বলেই ছিন্ন খঞ্জনীর মতো বাংলার নদী মাঠ ভাঁটাফুলে এখনো খুঁজে পায় শুশ্রুষার ধব্বনি । তাঁর ছবি প্রত্যেকটি বিশ্বাসযোগ্য শংসিত বাস্তবতার দ্বারা নিষিক্ত নয় কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যে চলচ্চিত্রীয় চোখ দিয়ে বিশ্বরূপ দর্শন করেছিল তেমনই কোনো চেতনার সৌজন্যে দেখতে পায় নদীর পাড়ে আর বস্তীর আঙিনায় ক্লেদ, কোলাহল, রক্ত, ও গ্লানির শেষে আত্মা স্নান করে উঠেছে । 'সুবর্ণরেখা' ভারতীয় ইতিহাসকে কুমারীত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে, বক্তব্যের দিক থেকে নয়, ভাষার দিক থেকেও । এই ছবির ছিন্ন পুঁথির অংশগুলি দেখলে তাই মনে হয় কৃত্তিবাসের মতন ' ভাষাপথ খননি স্ববলে ' ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র শাস্ত্রকে আমাদের মননে ও মৃত্তিকায় সম্ভব করলেন । দুর্ভাগ্য চল্লিশ বছর আগে এ কথা বলার লোক ছিল না । (২০০৩)

No comments: